CPI Maoist end : চারু মজুমদার, কানু সান্যাল, কিষেণজি, আর এবার বাসবরাজ। একটার পর একটা পরিচিত নামের মাওবাদী অধ্যায় গড়ে তুলেছে সত্তরের দশক থেকে। কিন্তু এবার কি সেই গল্পের শেষ পাতা লেখা হয়ে গেল? ছত্তীসগঢ়ের দণ্ডকারণ্যে অভিযান চালিয়ে যৌথ বাহিনী যেভাবে গত ২১ মে খতম করল মাওবাদীদের শীর্ষ নেতা নম্বলা কেশবরাও ওরফে বাসবরাজকে, তাতে একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে—এই কি শেষ?
নকশালবাড়ি থেকে দণ্ডকারণ্য: বিপ্লবের মানচিত্র বদল
নকশালবাড়ি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া এই সশস্ত্র বামপন্থার আগুন বাংলার বুকেই ছড়িয়েছিল শুরুতে। কলকাতার উচ্চশিক্ষিত যুবসমাজ, শহরের দেওয়ালে ‘লাল সেলাম’, প্রেসিডেন্সি কলেজের চুপিচুপির সভা—সব মিলিয়ে যেন এক বিপ্লবের লাল অঙ্কুর। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই বিপ্লব গিয়েছে ম্রিয়মাণ হয়ে।
বাংলা হারিয়েছে সেই জোয়ার, বদলে গেছে ভরকেন্দ্র। বিহার, মধ্যপ্রদেশ হয়ে ছত্তীসগঢ়ের বস্তার ডিভিশন হয়ে উঠেছে লাল জঙ্গলের নতুন দুর্গ।
অস্ত্র, আদর্শ আর আতঙ্ক
২০০৪ সালে CPI (Maoist) গঠনের পর থেকে মাওবাদীদের গেরিলা আন্দোলন আরও সংগঠিত হয়। লক্ষ্য ছিল—রাষ্ট্রবিরোধী অভিযান, নিরাপত্তা বাহিনীর উপর আক্রমণ, খনিজ-সমৃদ্ধ অঞ্চল দখল ও জনজাতিদের ‘ঢাল’ বানানো। মাওবাদী মহিলা কমান্ডারদের ভূমিকাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। অস্ত্র দিয়ে কাজ না হলে, আদর্শ দিয়ে ‘বশ’ করা হত স্থানীয়দের।
এই সময়কালে গোটা রেড করিডরে শত শত অপারেশন চালিয়েছে মাওবাদীরা। ২০১০ সালে এক বছরে ১,৯৩৬টি হিংসাত্মক ঘটনা ঘটিয়েছিল তারা। প্রাণ গিয়েছে ১,০০০-র বেশি মানুষের।
বদল আনল রাষ্ট্র, পাল্টে গেল ছক
কিন্তু ২০১০ পরবর্তী দশকে কেন্দ্রীয় সরকার, বিশেষ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক যখন একের পর এক অপারেশন শুরু করল—‘Greyhounds’, ‘COBRA’ বাহিনী তৈরি করে—তখন থেকেই লাল দুর্গে ফাটল পড়তে শুরু করে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ স্পষ্ট বলেছেন, ২০২৬ সালের মধ্যে দেশকে মাওবাদমুক্ত করাই লক্ষ্য। আর তার ফলও স্পষ্ট। ২০২৪-এ অপরাধের সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩৭৪-এ। ১৪০০-রও বেশি মাওবাদী আত্মসমর্পণ করেছেন মাত্র ১৬ মাসে।
বাসবরাজের মৃত্যু—মাওবাদী ভাবনার অন্তিম আঘাত?
বাসবরাজ শুধু মাওবাদী নেতা নন, ছিলেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক এবং সামরিক পরিকাঠামোর অন্যতম রূপকার। তার মাথার দাম ছিল ১ কোটি টাকা। কিষেণজির পর এটাই সম্ভবত মাওবাদী সংগঠনের সবচেয়ে বড় ধাক্কা।
সংগঠন এখন খুঁজছে নতুন নেতা। উঠে আসছে কিষেণজির ভাই বেণুগোপাল রাওয়ের নাম, কিংবা দলিত মুখ থিপ্পিরি তিরুপতির। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নেতা খুঁজে পেলেও হারিয়ে যাওয়া জমি ফেরানো কঠিন।
কেবল গুলি নয়, মতাদর্শও হতে পারে অস্ত্র
একটা অংশ মনে করে, গুলি দিয়ে শেষ হবে না মাওবাদ। আত্মসমর্পণের রাস্তা খুলে দিয়ে, মূল স্রোতে ফেরানোই হতে পারে ভবিষ্যতের সেরা কৌশল। আর তার ইঙ্গিত ইতিমধ্যেই পাওয়া যাচ্ছে।
উল্লেখ্য, নকশালবাড়ি থেকে শুরু করে বস্তারের জঙ্গলে শেষ রক্তপাত—ভারতের ইতিহাসে মাওবাদী আন্দোলন যেমনই ভয়াবহ, তেমনই তা আদর্শের লড়াইও। সেই আদর্শের ভগ্নাবশেষই হয়তো আজ হাওয়ায় মিশে যাচ্ছে। কিন্তু তার ছায়া কি কখনওই হারিয়ে যাবে? না কি আবারও একদিন, অন্য নামে, অন্য রঙে ফিরবে সে?