গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ইরানের বিভিন্ন শহরে লাগাতার ড্রোন হামলা ও ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে ইজরায়েল। মূলত হিজবুল্লাহ ও ইরানের বিপ্লবী গার্ডকে নিশানা করেই চলেছে এই হামলা, তবে এর প্রভাব এসে পড়েছে সাধারণ নাগরিক ও বিদেশি ছাত্রদের ওপরেও। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তেহরানের রাস্তাঘাট কার্যত শুনশান। দোকানপাট বন্ধ, বিমানবন্দরে অচলাবস্থা। এই আবহেই রাতের অন্ধকারে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ১১০ জন ভারতীয় ছাত্রকে সরিয়ে আনা হলো নিরাপদ স্থানে।
বিদেশমন্ত্রকের জরুরি অ্যাডভাইজারি, চুপিচুপি অপারেশন শুরু
গত রবিবার সন্ধ্যায় বিদেশমন্ত্রকের তরফে ইরানে থাকা ভারতীয়দের উদ্দেশে একটি জরুরি অ্যাডভাইজারি জারি করা হয়। তাতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছিল, কেউ যেন অপ্রয়োজনীয়ভাবে বাড়ির বাইরে না বেরোয়, এবং সমস্ত ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে। এই সতর্কতা জারির কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শুরু হয় ‘অপারেশন সাইলেন্ট শিফট’। কোনওরকম ঢাকঢোল না পিটিয়ে, সম্পূর্ণ গোপনীয়তায়, তেহরানের বিভিন্ন হোস্টেল ও আবাসন থেকে ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের একত্রিত করে নিয়ে আসা হয় দূতাবাসে। সেখান থেকে বিশেষ সশস্ত্র কনভয়ের মাধ্যমে তাদের স্থানান্তরিত করা হয় ইরানের এক নিরাপদ শহরে।
ছাত্রদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগে দূতাবাস, কড়া নজর দিল্লিরও
ভারতীয় দূতাবাস সূত্রে জানা গেছে, এই ১১০ জন ছাত্র মূলত ইরানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাশাস্ত্র, প্রকৌশল ও ইসলামিক স্টাডিজ নিয়ে পড়াশোনা করছিলেন। তাঁদের অনেকেই বিগত দুই থেকে তিন বছর ধরে তেহরানে অবস্থান করছেন। যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার পর থেকেই দূতাবাস তাঁদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছিল। শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি যখন সম্পূর্ণ অনিশ্চিত হয়ে ওঠে, তখনই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তাঁদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার। দিল্লিতে বিদেশমন্ত্রকের একটি বিশেষ মনিটরিং সেল তৈরি হয়েছে, যারা প্রতি ঘণ্টায় ইরানে অবস্থানরত ভারতীয়দের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখছে। প্রয়োজন হলে আরও ছাত্র ও প্রবাসীদের সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বলেও মন্ত্রক সূত্রে জানা গেছে।
“মনে হচ্ছিল যেন যুদ্ধের ময়দান”: বললেন এক ছাত্র
সরিয়ে আনার পরে এক ছাত্র সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “গত তিনদিন ধরে আমরা আতঙ্কে ছিলাম। বাইরে গুলির শব্দ, আকাশে ড্রোনের ভোঁ ভোঁ আওয়াজ—মনে হচ্ছিল আমরা কোনও যুদ্ধক্ষেত্রে আটকে পড়েছি। দূতাবাসের সাহায্যে নিরাপদ জায়গায় আসতে পেরে আমরা কৃতজ্ঞ।” আর এক ছাত্রী জানান, খাবার জোগাড় করাও দুষ্কর হয়ে উঠেছিল। দোকান বন্ধ, বাইরেও যাওয়া যায় না—তাই একপ্রকার বন্দি অবস্থাতেই কাটাতে হচ্ছিল। এই পরিস্থিতিতে ভারত সরকার তাদের যে দ্রুত সাড়া দিয়েছে, তা প্রশংসনীয়।
কূটনৈতিক স্তরে নজর, আন্তর্জাতিক মঞ্চে আলোচনার অপেক্ষা
ইজরায়েল ও ইরানের সংঘর্ষে নতুন মাত্রা পেয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা। এই পরিস্থিতি কতদিন চলবে তা কেউ জানে না, তবে ভারত সরকারের সক্রিয় ভূমিকা আপাতত রক্ষা করল বহু প্রাণ। তবে এই ঘটনা আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল, যুদ্ধ শুধু সেনা নয়, নিরীহ পড়ুয়া, প্রবাসী ও অসংখ্য সাধারণ মানুষের জীবনকেও বিপন্ন করে তোলে। ভারত সরকার এখন আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক স্তরে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চালাচ্ছে। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে যাতে আরও তৎপরতা ও প্রস্তুতির মাধ্যমে ভারতীয়দের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
আপাতত স্বস্তি, কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে
১১০ জন ভারতীয় পড়ুয়াকে সরিয়ে আনা গেলেও, এখনও তেহরান ও অন্যান্য ইরানি শহরে বহু প্রবাসী ভারতীয় রয়েছেন। যুদ্ধ পরিস্থিতি তীব্র হলে তাঁদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ থেকেই যাচ্ছে। ভারত সরকার যদিও আশ্বাস দিয়েছে, প্রয়োজন পড়লে আরও বড়সড় অপারেশন চালিয়ে সবাইকে ফিরিয়ে আনা হবে।
তবে প্রশ্ন উঠছে—এই ধরনের পরিস্থিতি আগে থেকেই অনুমান করা গেলে আরও দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া যেত কি? কতটা প্রস্তুত আমাদের বিদেশনীতি? আপাতত যদিও ছাত্রদের ফিরে পাওয়া গেছে নিরাপদ আশ্রয়ে, কিন্তু আন্তর্জাতিক অশান্তির এই সময়ে এমন আরও দুঃসংবাদ যেন অপেক্ষা না করে, এটাই এখন দেশবাসীর প্রার্থনা।