খিদের জ্বালায় নয়, এবার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ছারখার অরফ্যানগঞ্জ পুরবাজার। চোখের সামনেই ছাই হয়ে গেল বছরের পর বছর ধরে গড়া ব্যবসা, রুজিরুটি। বাঁচার আশা ছিল যেটুকু, সেটুকুও গিলে খেল দাউদাউ আগুন। ঘটনা কলকাতার বুকে, শহরের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের ঠিক মাঝখানে, অথচ পরিস্থিতি এমন যে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে লেগে গেল ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
অরফ্যানগঞ্জের দায় কলকাতা পুরসভার ঘাড়ে
২০২২ সালের ১০ অগাস্ট। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসনের অধীনে থাকা অরফ্যানগঞ্জ বাজারের দায়িত্ব তখন হস্তান্তরিত হয় কলকাতা পুরসভার হাতে। অর্থাৎ গত তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে এই বাজারের রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন, এমনকি অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থাও পুরোপুরি কলকাতা পুরসভার দায়িত্বে।
তা সত্ত্বেও, আগুন লাগলে শুধু দমকল নয়, বাজার ব্যবসায়ী থেকে সাধারণ মানুষ—প্রত্যেকেই বলছেন, “অন্তত ন্যূনতম ব্যবস্থাটুকু থাকলেও এত বড় ক্ষতি হতো না।”
গড়িয়াহাট থেকে এন্টালি, সব বাজারেই একই ছবি
শুধু অরফ্যানগঞ্জ নয়, এই ঘটনার পরে সামনে উঠে এসেছে আরও ভয়াবহ তথ্য। গড়িয়াহাট পুরবাজার, এন্টালি বাজার, পার্ক সার্কাস, বেহালা বা হাতিবাগান—প্রায় সব পুরবাজারেই একাধিক ঘিঞ্জি দোকান, প্লাস্টিকের ছাউনি, কাঠের চাল—যা আগুন ছড়াতে সাহায্য করে সহজেই।
সেই সঙ্গে নেই কোনও আপডেটেড অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা। অনেক জায়গায় অগ্নিনির্বাপন যন্ত্র থাকলেও, নেই স্মোক ডিটেক্টর বা ফায়ার স্প্রিঙ্কলার। ফলে, কোথাও আগুন লাগলে কয়েক মিনিটেই ছড়িয়ে পড়ে আশপাশে।
ব্যবসায়ীদের আতঙ্ক, প্রশাসনের দায় এড়ানোর চেষ্টা?
আগুন লাগার পরে ব্যবসায়ীরা যতটা অসহায়, প্রশাসন ততটাই নির্লিপ্ত। বহু ব্যবসায়ী বলছেন, বাজারে প্রতি বছর ফি তোলা হয় “রক্ষণাবেক্ষণের নামে”, অথচ কখনও কোনও আগুন নিয়ে মহড়া হয় না, পুরসভার পক্ষ থেকে কোনও সচেতনতা শিবির হয় না, এমনকি কোথায় কোন অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র আছে, তা-ও জানেন না অনেক দোকানদার। এক ব্যবসায়ী বলেন, “আমাদের দোকান তো গেলই, সঙ্গে গেল ধার-কর্জ করে কেনা মাল। পুরসভা এখন মুখ লুকিয়ে আছে।”
পুরসভার ব্যাখ্যা কোথায়?
এখনও পর্যন্ত কলকাতা পুরসভার পক্ষ থেকে এই আগুন নিয়ে কোনও বিস্তারিত বিবৃতি সামনে আসেনি। দমকল দফতরের তরফে জানানো হয়েছে, “বাজারগুলির ভেতরে ঢোকাই যায় না ঠিকমতো। বিপর্যয় মোকাবিলা ব্যবস্থা লাগু করতে হলে পুরসভার সঙ্গে সমন্বয় প্রয়োজন।”
অগ্নিকাণ্ড শুধু পুরনো কাঠামো বা দোষারোপের গল্প নয়, এটা শহরের প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তার প্রশ্ন। এমন ঘিঞ্জি ও বিস্ফোরক জায়গাগুলিতে বারবার যদি আগুন লাগে আর বারবার যদি কেউ দায় না নেয়—তাহলে সেই দায় কার? এখন প্রশ্ন একটাই—কলকাতা শহর কি পরবর্তী ‘জতুগৃহ’-এর পথে? নাকি এবার সত্যিই ঘুম ভাঙবে কর্তৃপক্ষের?