শুধু একটা ভিডিয়ো কল। তাও পাঁচ দিন আগে। তারপর নিঃসঙ্গতা, অজানা আশঙ্কা আর না ঘুমনোর রাত। বেঙ্গালুরুর রিচমন্ড টাউনের এক ছোট্ট ফ্ল্যাটে যেন প্রতিদিন কাটছে অনন্ত যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে। কারণ, ওই বাড়ির মেয়েটি—ফারিহি মেহেদি, এখন যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরানে আটকে।
“শেষবার কথা হয়েছিল ছ’দিন আগে…”
ফারিহি মেহেদি, ইরানের তেহরান ইউনিভার্সিটি অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেসে ডাক্তারি পড়েন। তাঁর বাবা ইমরান মেহেদি জানাচ্ছেন, “১৩ জুন মেয়ের সঙ্গে শেষ কথা হয়েছিল। তেহরানেই যেই জায়গায় ও থাকে, সেখানেই তখন এক বিশাল বিস্ফোরণ ঘটে। সেই আওয়াজ শুনে বুঝেছিলাম, পরিস্থিতি কতটা খারাপ।” মা শাবানা মেহেদি জানাচ্ছেন, “আমার মেয়ে তো কখনও যুদ্ধ দেখেনি। কীভাবে আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয়, জানেই না। ফোনে কান্না করে বলছিল, খুব ভয় করছে। তারপর হঠাৎ একদিন সব যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেল।”
ফিরিয়ে আনার সব চেষ্টা ভেস্তে যায়
ইমরানবাবু মেয়েকে ফিরিয়ে আনার জন্য তড়িঘড়ি বিমানের টিকিট কাটার চেষ্টা করেন। ১৫ জুনের আগে কোনও ফ্লাইট পাননি। কিন্তু তার আগেই ইরান তাদের আকাশসীমা বাণিজ্যিক বিমানের জন্য বন্ধ করে দেয়। “বুকের মধ্যে পাথর চাপা নিয়ে শুধু ভাবছিলাম—কীভাবে মেয়েকে ফিরিয়ে আনি। কিন্তু কিছুই করতে পারিনি,” কান্না চেপে বলেন ইমরান।
ভারত সরকার কী বলছে?
বিদেশ মন্ত্রকের তরফে ফারিহির পরিবারকে জানানো হয়েছে, একদল ভারতীয় পড়ুয়াকে ইরান থেকে আর্মেনিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তবে ফারিহি এখনও ইরানেই, তেহরান থেকে ছয়-সাত ঘণ্টার দূরত্বে এক ‘নিরাপদ জায়গায়’ রাখা হয়েছে। তাঁর অবস্থান গোপন রাখা হয়েছে নিরাপত্তার কারণে। শাবানা বলছেন, “আমি মেয়ে হিসেবে নয়, একজন মা হিসেবে বলছি—ওর মতো আরও অনেক ভারতীয় সন্তান সেখানে আটকে। সরকারকে অনুরোধ করছি, ওদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরিয়ে আনুন। এক মায়ের কণ্ঠস্বর যেন সব অভিভাবকের হয়ে পৌঁছয় দিল্লি পর্যন্ত।”
‘অপারেশন সিন্ধু’ শুরু
ইজরায়েল-ইরান যুদ্ধ পরিস্থিতিতে আটকে পড়া ভারতীয়দের উদ্ধার করতে ‘অপারেশন সিন্ধু’ নামের বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে ভারত সরকার।
বৃহস্পতিবার ভোররাতে ১১০ জন ভারতীয় ছাত্রছাত্রীকে নিয়ে প্রথম বিমানটি দিল্লিতে অবতরণ করেছে। তারা তেহরান থেকে আর্মেনিয়া, সেখান থেকে দোহা হয়ে দেশে ফিরে এসেছে। ফারিহির পরিবার এখন কেবল অপেক্ষা করছে, কখন সেই বিমান ধরতে পারবে তাঁদের মেয়ে।
তেহরানের রাস্তায় বিস্ফোরণ, রিচমন্ড টাউনে নিস্তব্ধতা
যুদ্ধ কেবল সীমান্তে থেমে থাকে না। তার অভিঘাত ছড়িয়ে পড়ে শহরের অলিগলিতে, আর পরিবারের বুকের মধ্যে। বেঙ্গালুরুর ওই ফ্ল্যাটে এখন শুধু দুশ্চিন্তা আর প্রার্থনার বাতাস। “মেয়ে বেঁচে থাকুক, বাকি কিছুর দরকার নেই”— এতটাই অনিশ্চিত পরিস্থিতি, এতটাই ভয় আর অপেক্ষা।
তেহরানের কোনও গলিতে হয়তো এখন মাথা নিচু করে লুকিয়ে বসে আছেন ফারিহি। আর হাজার কিলোমিটার দূরে, বেঙ্গালুরুর এক মা-বাবা প্রতিটা সেকেন্ডে মেয়ের ফিরে আসার খবর শোনার অপেক্ষায়। যুদ্ধ শুধু রক্ত ঝরায় না, রক্ত-মাংসের সম্পর্কও ছিন্ন করে দেয় সময়ের গহ্বরে। এখন সারা দেশের অপেক্ষা—আর কত দেরি অপারেশন সিন্ধু শেষ হতে?