দিঘার জগন্নাথ ধামের উন্মোচনের পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের প্রতিটি ঘরে দেবতার ‘মহাপ্রসাদ’ পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সেই প্রতিশ্রুতি পূরণে এবার রাজ্য সরকার আনতে চলেছে এক বিশেষ উদ্যোগ—রেশন কার্ড দেখালেই বায়োমেট্রিক যাচাই ছাড়া মিলবে শ্রীজগন্নাথের খোয়া-ক্ষীর ও গজাপেঁড়া-ভোজ।
শুরু হচ্ছে প্রসাদ বিতরণ, কোনো জটিলতা নয়
খাদ্যমন্ত্রী রথীন ঘোষ জানালেন, ২০ জুন থেকে দক্ষিণবঙ্গে ধাপে ধাপে শুরু হবে মহাপ্রসাদ বিতরণ। রাজ্যের সরকারি ‘দুয়ারে রেশন’ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রত্যেক রেশনদারকেই সহজে পৌঁছে যাবে ভোগ-ভোজন। প্রতিটি গ্রাম ও শহরের মডেল রেশন দোকানে রেশন কার্ড দেখালেই, আবেদনখাতায় স্বাক্ষর করলেই দাদা–ভাই, বোনেরা পাবেন দেবতার খাওয়া।
কেন ছাড়া হল বায়োমেট্রিক যাচাই?
আগে রেশন বণ্টনের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক ছিল ফিঙ্গারপ্রিণ্ট কিংবা বায়োমেট্রিক যাচাই। কিন্তু অনেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, শারীরিক প্রতিবন্ধী কিংবা অসুস্থ মানুষের জন্য তা হয়ে ওঠে সমস্যার জন্ম—দেখতে পাওয়া যায় দাগ মুছে ফিঙ্গারপ্রিণ্ট পড়ে না কিংবা হাত কেঁপে যাচাই কেসরি। সেই কারণেই এবার অভিন্ন রেশন কার্ডেই ভরসা রাখল সরকার। খাদ্যমন্ত্রী বললেন, “ধর্মীয় আবেগ ও জনস্বার্থের কথা মাথায় রেখে এই নিয়ম ছাড়া হয়েছে।”
কী থাকবে দেবতার ভোজে?
গত ৯ জুন পুজোয় নিবেদিত হয়েছিল ৩০০ কেজি খোয়া-ক্ষীর। সেরাই মিশ্রিত হবে সুনির্বাচিত গজা ও পেঁড়ার সঙ্গে—শ্রীজগন্নাথ মন্দিরের ঐতিহ্যবাহী পদ্মখাদ্য। সেই মহাপ্রসাদই আর এক সপ্তাহ অপেক্ষা ছাড়াই পৌঁছে যাবে রাজ্যের প্রতিটি রেশনদারের হাতে। খেতে হবে ভোরবেলার অন্নপূর্ণ চরিতামৃত বোধ নিয়ে, বলছেন ধর্মপ্রয়াত বুড়োমামা থেকে তরুণ-তরুণীরা সবাই।
প্রাথমিক প্রস্তুতি ও লজিস্টিক
প্রসাদ প্যাকেজিং শুরু হয়েছে জেলাস্তরে—জেলার মহকুমাশাসকের তত্ত্বাবধানে চলছে পরিবহন ব্যবস্থা গড়ার কাজ। রেশন দফতরের কর্মকর্তারা ইতিমধ্যেই রেশনদার তালিকা আপডেট করেছেন, যাতে কেউ বাদ না পড়ে। ঠাণ্ডা ও সানুষ্ণ পরিবহনের জন্য পুরনো ডেলিভারি ভ্যান-ট্রাক ব্যবহার হচ্ছে। প্রত্যেক প্যাকেটে সিলমোহর তোলা হচ্ছে, যাতে পথিমধ্যেই কোনও ঝামেলা না হয়।
মানুষের প্রতিক্রিয়া
রাজ্যের প্রত্যন্ত গ্রামের মাঠ-কৃষক থেকে শহরের উদ্বাস্তু পরিবার—সর্বত্রই খুশির ঢেউ। অবসরের বাড়িতে জন্মেছেন মায়ের মতো আবেগ। “এ ধরনের অনুষ্ঠান আগে দেখিনি,” বললেন পুরুলিয়ার লক্ষ্মীনাথ দাশ, “বায়োমেট্রিক না দেখেই দেবতার ভোগ পাবে ছেলে-মেয়ে।” স্কুলের টিফিন ঘর কাজ মেলে না এমন অনেক মা পেয়েছেন সামান্য স্বস্তি।
রাজনৈতিক বার্তা ও সমালোচনা
বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন, ধর্মীয় আবেগের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে জনযোগাযোগ বাড়াতে চায় তৃণমূল সরকার। তবে বিরোধী দাবি, এটা রাজনৈতিক হেরফেরের অংশ মাত্র। “পেটের উপরে ভগবান—কিন্তু ভোটের বয়ানও তো সরাসরি,” প্রশ্ন তুলেছেন বিজেপি নেতা। তবু অনেকে বলছেন, এই প্রকল্প সামাজিক সংহতির একটি স্পন্দনাত্মক দিকও উন্মোচিত করছে।
বায়োমেট্রিকের ভয়-ভীতি ছাপিয়ে এবার রেশন কার্ডেই মিলছে ঐতিহ্যবাহী শ্রীজগন্নাথের মহাপ্রসাদ। প্রশাসন ও জনসেবা সংযুক্ত এই মিশন সত্যিই এক নজির সৃষ্টি করবে। ২০ জুন থেকে শুরু, তারপর প্রতিটি বাড়িতে ভোগ-ভোজনের মূহুর্ত—মিথ্যে নয়, ফের ধর্মীয় আস্থা ও সামাজিক সদিচ্ছার মিলন ঘটবে বাংলার মাঠ-ঘাটে। এখন শুধু অপেক্ষা, যখন মাস্টার কার্ড নয়, রেশন কার্ড দেখালেই দেবতার খোয়া-ক্ষীর মুখরোচক স্বাদ দিতে আসবে ঘরে।