Plastic Crisis Kolkata : ‘আজ যেখানে আবর্জনার স্বৈরিতা’— কবি দীনেশ দাসের কথাগুলো যেন ২০২৫ সালের কলকাতার বাস্তবচিত্র। শহরের প্রতিটি কোণায় ছড়িয়ে আছে প্লাস্টিকের স্তুপ। রাস্তা, নিকাশি, পুকুর থেকে শুরু করে জলাশয়—সব জায়গাই যেন প্লাস্টিকে ঢেকে গেছে। আজ ৫ জুন, বিশ্ব পরিবেশ দিবস। কিন্তু এদিন শহরের বাস্তবতা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়—এই শহর এখনও প্রস্তুত নয় পরিবেশকে রক্ষা করতে।
আইন আছে, প্রয়োগ নেই!
ভারত সরকার ২০২২ সালের মধ্যে দেশকে সিঙ্গল ইউজ প্লাস্টিকমুক্ত করার কথা বলেছিল। ২০২৩ থেকে ১২০ মাইক্রনের কম প্লাস্টিক নিষিদ্ধ হলেও, আজও তা সর্বত্র ব্যবহৃত হচ্ছে। কলকাতায় নেই কোনও সংগঠিত প্লাস্টিক সংগ্রহের পরিকাঠামো। হাতে গোনা কিছু ইউনিট থাকলেও, সেগুলি কার্যত অকেজো। হাজার হাজার র্যাগ পিকার (ময়লা কুড়ানিরা) সম্পূর্ণ অনানুষ্ঠানিকভাবে এই কাজ করছেন। অথচ ২০১৬ সালের আইনে তাঁদের স্বীকৃতি দেওয়ার কথা ছিল।
পরিসংখ্যান বলছে, বিপদ বড়
রাজ্যে প্রতিদিন উৎপন্ন হয় প্রায় ১৩,৪৬৯ টন কঠিন বর্জ্য, যার ১০ শতাংশ প্লাস্টিক। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ১,৩৫০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য জমছে।সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের (CSE) এক রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৯-২০ সালে পশ্চিমবঙ্গে ৩ লক্ষ টনের বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য জমেছে। এর মধ্যে মাত্র ১৩ শতাংশ রিসাইকেল হয়েছে। বাকি অংশ জ্বালানো হয়েছে অথবা বেআইনিভাবে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
কারখানা চলছেই, নিষেধাজ্ঞা শুধুই কাগজে
রাজ্যে ১২০০-রও বেশি প্লাস্টিক উৎপাদনকারী কারখানা আছে। কিন্তু প্রশাসন কার্যত নীরব। অবৈধ আমদানি-রপ্তানি বন্ধ করার কোনোরকম কার্যকর পদক্ষেপ নেই। এমনকি হকার, দোকান, সুপারস্টোরে যে প্লাস্টিক ব্যাগ দেওয়া হয়, তাতেও মান নির্ধারিত ছাপ না থাকায় আইন লঙ্ঘন হচ্ছে প্রতিদিন।
পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য—দুইই চরম বিপন্ন
এই প্লাস্টিক জমে মাটির উর্বরতা নষ্ট করছে। নদী ও জলাশয়ে ফেলে দিয়ে জলদূষণ এবং জলে অক্সিজেনের পরিমাণ কমিয়ে জলজ প্রাণীর মৃত্যুর কারণ হচ্ছে। বাতাসে জ্বালানো হলে তৈরি হচ্ছে বিষাক্ত গ্যাস, বাড়ছে শ্বাসকষ্ট, ক্যান্সারের মতো রোগের আশঙ্কা।
পুরসভা ও পঞ্চায়েত ব্যর্থতার নামান্তর?
২০১৬ সালের কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আইন অনুযায়ী, প্রত্যেক পুরসভা ও পঞ্চায়েতকে আবর্জনার জন্য পৃথক পরিকাঠামো গড়ে তোলার নির্দেশ ছিল। অথচ এখনও পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের ১২৮টি পুরসভার কোনওটিতেই পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা নেই। রাজ্যের ৪১ হাজার গ্রামের মধ্যে মাত্র ১১৯টি গ্রামে কঠিন বর্জ্য ও ২১টি গ্রামে তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা চালু হয়েছে।
কী করা উচিত এখনই?
-
রাজ্যে প্লাস্টিক উৎপাদনকারী কারখানাগুলির ওপর কঠোর নজরদারি
-
র্যাগ পিকারদের স্বীকৃতি ও স্বাস্থ্যসেবা
-
সঠিক রিসাইক্লিং ইউনিট তৈরি
-
প্যাকেজিং প্লাস্টিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে ব্র্যান্ডগুলিকে দায়িত্ববদ্ধ করা
-
পুরসভা ও পঞ্চায়েত স্তরে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পূর্ণ বাস্তবায়ন
-
নাগরিকদের সচেতনতা বাড়াতে উদ্যোগ
রাষ্ট্রপুঞ্জের থিম, ভারত সরকারের সংকল্প, নানা আইন—সবকিছুই থাকছে শুধু কাগজে-কলমে। কিন্তু বাস্তবের কলকাতা আজ প্লাস্টিক দূষণে নাকাল। এর থেকে মুক্তির একমাত্র উপায়—আইন প্রয়োগে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক কঠোরতা এবং নাগরিকের সক্রিয় অংশগ্রহণ।এভাবে চলতে থাকলে, ভবিষ্যতের কলকাতা থাকবে না—থাকবে শুধুই প্লাস্টিকের শহর।