যেখানে প্রযুক্তি, অর্থনীতি, এবং বিজ্ঞানে মানুষ প্রতিনিয়ত নতুন নতুন উচ্চতায় পৌঁছচ্ছে, সেই পৃথিবীতেই আবার ফিরে এসেছে অনাহার। শুধু একটা বেলাও খাবার জোটে না, এমন মানুষের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছেই। রাষ্ট্রসংঘের অধীনস্থ সংস্থা FAO (Food and Agricultural Organization)-এর এক রিপোর্ট চমকে দিয়েছে গোটা বিশ্বকে। তারা জানিয়েছে, ২০২৪ সালে বিশ্বের অন্তত ৫৩টি দেশে খাদ্য নিরাপত্তা ভয়াবহভাবে কমে গেছে। এই মুহূর্তে প্রায় ২৯ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষ জানেন না, আজ তাঁরা খেতে পাবেন কিনা।
টানা ৬ বছর ধরে বেড়েই চলেছে অনাহার
এই পরিস্থিতি হঠাৎ করে তৈরি হয়নি। রাষ্ট্রসংঘ বলছে, টানা ছয় বছর ধরে বিশ্বজুড়ে অনাহারের হার বেড়েই চলেছে। ২০২৩ সালের তুলনায় এবার সংখ্যাটা আরও ১ কোটি ৩৭ লক্ষ বেশি। প্রতি বছর তৈরি হচ্ছে ‘খিদের নতুন রেকর্ড’।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ—দ্বন্দ্ব-সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন, অর্থনৈতিক বৈষম্য, এবং খাদ্য ব্যবস্থাপনায় ভয়ানক অপচয়।
একশ্রেণির মানুষের প্লেটে ফেলে দেওয়া খাবারই অন্যের জীবন রক্ষার সমান
রাষ্ট্রসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বিষয়টি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁর মতে, “যত দ্রুত ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াই হওয়া উচিত, ততটা কাজ বিশ্ব করছে না। আর সেই কারণেই প্রতি বছর খিদের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন মুখ।” গুতেরেস আরও একটি চরম বাস্তবতাও সামনে এনেছেন, সেটি হলো, বিশ্বে উৎপাদিত মোট খাদ্যের এক-তৃতীয়াংশ নষ্ট হয়ে যায়। গুতেরেসের মতে এই অপচয় যদি কমানো যেত, তাহলে অনায়াসে কোটি কোটি ক্ষুধার্ত মানুষকে বাঁচানো যেত। অথচ সেই সচেতনতা আজও তৈরি হয়নি।
শিশুরা সবচেয়ে বড় শিকার
খিদের সবচেয়ে নির্মম শিকার হচ্ছে শিশুরা। অপুষ্টিতে ভুগছে লাখ লাখ শিশু। অনেকের জন্ম হলেও বেড়ে ওঠা আটকে যাচ্ছে অনাহারের গ্লানিতে। ছোট ছোট শরীরে পুষ্টিহীনতা এমনভাবে বাসা বাঁধছে, যা তাদের ভবিষ্যৎ একেবারে অন্ধকার করে দিচ্ছে।
প্রযুক্তির চেয়ে দরকার সচেতনতা
বিশ্ব যতই রোবট তৈরি করুক, চাঁদে ঘর বানানোর পরিকল্পনা করুক—সব কিছু ম্লান হয়ে যায়, যখন একবেলার খাবার জোগাড় করতে না পেরে কোনো মা তার সন্তানের মুখ চেয়ে অসহায়ভাবে কাঁদে। এ লড়াই শুধু খাদ্য নয়, এ লড়াই মানবিকতার। রাষ্ট্রসংঘের রিপোর্ট আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, আজও পৃথিবীর একটা বিরাট অংশ আধুনিক সভ্যতার আলো থেকে অনেক দূরে।
এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় যুদ্ধটা অস্ত্র দিয়ে নয়, খাদ্য দিয়ে হওয়া উচিত। আর তা শুধু রাষ্ট্র বা সরকারের দায়িত্ব নয়, আমাদের প্রত্যেকেরও। খাবার নষ্ট করা বন্ধ করা, বঞ্চিতদের পাশে দাঁড়ানো, এবং খাদ্য সচেতনতা বাড়ানোই হতে পারে এই ভয়ানক পরিস্থিতি থেকে মুক্তির প্রথম পদক্ষেপ।