১৯৭৫ সালের ২৫ জুন দেশে জারি হয়েছিল জরুরি অবস্থা। তার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে কেন্দ্রীয় সরকার দেশের সব রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলকে একটি চিঠি পাঠিয়েছে, যেখানে ২৫ জুন দিনটিকে ‘সংবিধান হত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের অনুরোধ করা হয়েছে। সরকারি সূত্রে জানা গিয়েছে, এই দিনটির মাধ্যমে ‘গণতন্ত্রের উপর আঘাত’ স্মরণ করার কথা বলা হয়েছে।
কিন্তু কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তে প্রবল আপত্তি তুলেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সোমবার এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বিজেপিকে নিশানা করে বলেন, “যারা আজ সংবিধান রক্ষার পাঠ পড়াচ্ছে, তারাই তো দিনের পর দিন সংবিধানের অপমান করে চলেছে।”
মমতার তীব্র কটাক্ষ বিজেপিকে
মমতার মতে, সংবিধান হত্যা আসলে আজকের সময়ের সবচেয়ে বড় বাস্তবতা এবং তার দায় বর্তায় বিজেপির উপরই। তিনি বলেন, “সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে দুর্বল করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে। মানুষকে ভয় দেখিয়ে কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে। যারা এসব করছে, তারাই আবার সংবিধান হত্যা দিবস পালন করতে বলছে! এটা হাস্যকর।”
মুখ্যমন্ত্রী অভিযোগ করেন, “রাজ্যে রাজ্যে সরকার ফেলা, বিরোধীদের বিরুদ্ধে ইডি-সিবিআই লাগানো—এসবই সংবিধান লঙ্ঘনের নমুনা। আজ যারা কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন করছে, তারাই তো গণতন্ত্রকে খাদের কিনারায় নিয়ে এসেছে।”
গণতন্ত্র বাঁচাতে পথে নামার আহ্বান
মমতা আরও বলেন, “এই কেন্দ্রীয় নির্দেশ আসলে রাজনৈতিক প্রহসন ছাড়া কিছুই নয়। বিজেপি সংবিধানকে যেমনভাবে ব্যবহার করছে, তাতে এই দিবস পালন করাটা একটা কৌতুকের মতো শোনায়। আমরা এই রাজনৈতিক ফাঁদে পা দেব না।”
তিনি বাংলার মানুষকে এবং দেশের সমস্ত প্রগতিশীল শক্তিকে আহ্বান জানিয়েছেন, “গণতন্ত্র বাঁচাতে এবার রাস্তায় নামতেই হবে। সময় খুব কম। আগামী লোকসভা নির্বাচনে এই সরকারের মুখোশ খুলে ফেলতে হবে।”
তৃণমূলের পাল্টা কর্মসূচি
তৃণমূল কংগ্রেস সূত্রে জানা গিয়েছে, ২৫ জুন দিনটিতে দল নিজের মতো করে একটি ‘গণতন্ত্র রক্ষা দিবস’ পালন করার পরিকল্পনা করছে। সেই দিন বিশেষ কর্মসূচি নিয়ে পথে নামবে রাজ্যের শাসকদল। মূলত বিজেপির বিরুদ্ধে ‘সংবিধান লঙ্ঘনের ইতিহাস’ তুলে ধরতে চাইছে তৃণমূল।
দলের এক মুখপাত্র বলেন, “আজকের দিনে যারা কথায় কথায় দেশভক্তি, সংবিধান আর সংস্কৃতির কথা বলে, তারাই আসলে এই দেশকে বিভাজিত করার কাজ করছে। আমরা সত্যিটা মানুষের সামনে তুলে ধরব।”
বিশেষজ্ঞদের মত কী বলছে
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, কেন্দ্রের এই পদক্ষেপ আসলে আগামী নির্বাচনের আগে একটি ‘পলিটিক্যাল ন্যারেটিভ’ তৈরি করার চেষ্টা। ১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থাকে তুলে ধরে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের চেষ্টা করছে বিজেপি। কিন্তু পাল্টা কৌশল হিসেবে তৃণমূল ও অন্যান্য বিরোধী দলগুলি বর্তমান সময়ের ‘গণতান্ত্রিক সংকট’-এর বিষয়টি তুলে ধরছে।
একজন রাজনীতি বিশ্লেষকের ভাষায়, “১৯৭৫-এ যা হয়েছিল, তা ইতিহাস। কিন্তু ২০২৫-এ মানুষ ঠিক কী অনুভব করছে—তা আরও গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ এখন কেন্দ্রীয় স্বৈরতন্ত্র নিয়ে উদ্বিগ্ন। এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করা যাবে না।”
জরুরি অবস্থার বর্ষপূর্তিকে কেন্দ্র করে ‘সংবিধান হত্যা দিবস’ পালন—এই সিদ্ধান্ত যেন দেশের রাজনৈতিক মহলে নতুন করে বিভাজন তৈরি করল। এই বিতর্ক শুধু অতীতের দিকে ফিরে তাকানো নয়, বরং আজকের বাস্তবতাকেই সামনে এনে দিল। আর সেই বাস্তবতা থেকে চোখ সরাতে নারাজ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার সাফ বার্তা—“সংবিধানকে আমরা রক্ষা করব, কেন্দ্রের প্রহসন নয়।”